পাঁচ টি ট্যাকটিকাল জিনিস যা আমরা ইউরো থেকে শিখলাম

রোমাঞ্চকর ইউরো ২০২০ এর শিরোপা কার হাতে উঠবে, সেই প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর ২৪ থেকে ৪ এ নেমে এসেছে। সেমিফাইনাল এ মুখোমুখী হচ্ছে নতুন আক্রমণাত্মক ইটালি এবং নিজেকে খুঁজে পাওয়া স্পেন, সাথে “ঘরে ফেরানোর” আশায় বুক বাঁধা ইংল্যান্ড ও এরিকসেন এর প্রেরণা কে দ্বাদশ খেলোয়াড় বানিয়ে চমক দেখানো ডেনমার্ক। গ্রুপ স্টেজ ও নক আউট পর্বের ম্যাচ সমূহ হয়ে উঠেছিল ইউরোপিয়ান ফুটবল এর সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন, যেখানে দুর্দান্ত ক্রীড়াশৈলীর মাধ্যমে ফুটবল অনুরাগী দের মন জয় করেছে দল গুলো। এগারো বনাম এগারো এর লড়াই এ রণসজ্জায় কোচেরা কখনো দেখিয়েছেন মুন্সিয়ানা, কখনো বা সামান্য ভুল এ দল কে ফেলে দিয়েছেন পরাজয়ের খাদে। আসর শেষে এই টুর্নামেন্ট ফুটবল রণকৌশল-অনুসন্ধিৎসু দের আতসী কাঁচের নিচে পড়বে তা বলাই বাহুল্য। শিরোপা নির্ধারণের থেকে তিন ম্যাচ দূরে থাকতে থাকতে তার এই একটি প্রয়াস আমরা নিলাম।
পাঁচ টি ট্যাকটিকাল জিনিস যা আমরা ইউরো থেকে শিখলামঃ
১- উইংব্যাক ও ফুলব্যাক এর ব্যবহার:
    দল এর আক্রমণ এ মাঠ এর ব্যবহার সর্বোচ্চ করার জন্য ফুলব্যাক দের আক্রমণে ওভারল্যাপ করা টা অনেক দিন ধরেই হয়ে আসছে, এই ইউরো তেও সেই ধারা বজায় আছে। ইটালি এর স্পিনাজ্জোলা, চেক প্রজাতন্ত্রের সুফাল, পর্তুগাল এর গুয়েরেরো রা চার জনের ডিফেন্স এ রক্ষণ সামলানোর পাশাপাশি আক্রমণে উঠেও দল কে সাহায্য করছেন। কিন্তু এই ইউরো তে ফুলব্যাক দের তুলনায় উইং ব্যাক দের ভূমিকা এর প্রাধান্য ও ভিন্নতা বেশী দেখা গিয়েছে। গত কয়েক বছরে ইউরোপিয়ান ফুটবল এ জুভেন্টাস, আটালান্টা, চেলসি, লাইপজিগ এর কল্যাণে ৩ জন এর ডিফেন্স এ উইংব্যাক দের ভূমিকা আমরা দেখে আসছি। এবারের ইউরো তে সুইজারল্যান্ড, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক,নেদারল্যান্ডস, অষ্ট্রিয়া, স্কটল্যান্ড, জার্মানি প্রমুখ টিম এই ভাবেই আক্রমণ এ প্রশস্ততা বাড়াচ্ছে, এবং সাফল্য ও পাচ্ছে। থরগান হ্যাজার্ড, মায়হেল, ডাম্ফ্রাইস, লাইনার, রবার্টসন, কিমিখ, গোসেন্স – ক্লাব ফুটবল এর চেনা মুখেরা এবার ওভারল্যাপ এর থেকে আন্ডারল্যাপ ( উইং এর দিকে না গিয়ে গোল পোস্ট বরাবর কোনাকুণি যাওয়া) এর মাধ্যমে দল এর গোল করার সম্ভাবনা বাড়াচ্ছেন। বিশেষ করে ডাম্ফ্রাইজ, গোসেন্স গোল পোস্ট বরারবর কোণাকুণি বিপদজনক দৌড়, মায়হেল বক্স এর বাইরে থেকে ইনভার্টেড উইঙ্গার দের মত শট নিয়ে ও ড্রিবল করে বিপক্ষ দল কে যেই বিপদ এ ক্রমাগত ফেলছেন, তাতে এবার ইউরো থেকে উইংব্যাক খেলানো টা প্রথা হিসেবে শুরু হয়ে গেলে অবাক হবার কিছু নেই। মায়হেল ও স্পিনাজ্জোলা এর বাম প্রান্ত দিয়ে ডান পায়ের আক্রমণ আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে ফিলিপ লাম এর কথা। লুক শ এর কথা আলাদা করে
 না বললেই নয়। ফুলব্যাক ও উইংব্যাক- দুই পজিশন এই শেষ দুই ম্যাচ এ গত সিজনের ফর্মের ছাপ রেখেছেল ইংল্যান্ড এর এই লেফট ব্যাক। তিন টি এসিস্ট ও জার্মানি এর সাথে একটি গোল এর সূচনা, সাথে রহিম স্টার্লিং ও জ্যাক গ্রীলিশ এর সাথে তাঁর রসায়ন ইংল্যান্ড কে ডেনমার্ক এর বৈতরণী পার হবার আশা দিচ্ছে।
২- তিন ডিফেন্ডার এর ব্যবহারঃ
 ৪-৩-৩, ৪-২-৩-১, ৪-৪-২ অনেক দিন ধরেই আন্তর্জাতিক ফুটবল এ সাফল্যের সূত্র হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। তবেঁ এবার যেন কিছু টা ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে, বড় দল গুলোর তিন ডিফেন্ডার খেলানোর দিকে নজর দেওয়ায়। ৩-৪-৩ (জার্মানি, বেলজিয়াম), ৩-৫-২ (হল্যান্ড) প্রভৃতি ফর্মেশন কোচ দের হোয়াইটবোর্ড এ জায়গা করে নিচ্ছে প্রধানত দুইটি কারণেঃ দল এর ডিফেন্স কে আরো নিশ্ছিদ্র করা এবং ফুলব্যাক দের আক্রমণে আরো উঠতে উতসাহিত করার জন্য। জার্মানি এর ডিফেন্স এ সমস্যা অনেক দিন ধরেই প্রকট থাকায় তারা এই ফর্মেশন এ অনেক দিন ধরেই খেলার চেষ্টা করছে। বেলজিয়াম ২০১৮ বিশ্বকাপ থেকেই এই ফরমেশন এ খেলে অভ্যস্ত, ইংল্যান্ড বাছাইপর্বে প্রায়শই এই ফর্মেশন এ খেলেও এবার তারা ৪ ডিফেন্ডার খেলানোর পক্ষে আছে। হল্যান্ড ভার্জিল ভ্যান ডাইক এর ঘাটতি পূরণ এর জন্য ৩-৫-২ বেছে নিয়েছে, যেই ফর্মেশন এ খেলার মত যথেষ্ট পরিমান বল প্লেইং ডিফেন্ডার ও উইংব্যাক তাদের আছে। তবেঁ এইক্ষেত্রে চমক দেখিয়েছেন ডেনমার্ক কোচ ক্যাসপার হেলমুন্দ। এরিকসেন এর টুর্নামেন্ট শেষ হয়ে যাওয়ার পর ডেনমার্ক তার বিকল্প মধ্যমাঠে না পেয়ে কায়ের ও ক্রিসচেনশেন এর পাশাপাশি আরেক নির্ভরযোগ্য সেন্টার ব্যাক ভেস্টেরগার্ড কে একাদশ এ এনে ৪-২-৩-১ এর জায়গায় ৩-৪-৩ এ খেলে বিপক্ষ দল কে আরো ভালো করে চেপে ধরতে পেরেছে, দুই উইং এ মায়হেল ও ড্যামসগার্ড এর মাধ্যমে আক্রমণ চালিয়ে।
৩- নির্ধারিত একাদশঃ
ইংল্যান্ড, স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, পর্তুগাল, ইটালি – সব টিম এই ২০ জন এর মত খেলোয়াড় আছেন, যাদের কে নিয়ে দুইটি দল করে নিজেদের মধ্যে খেলানো হলে প্রথম দল এর জিততে রক্তের শেষ বিন্দু দিয়ে দিতে হবে। বেঞ্চে শক্তিশালী বিকল্প থাকা সাফল্যের একটা রসায়ন হলেও, কোচের সিদ্ধান্তহীনতার জন্য হিতে বিপরীত হয়ে মাথা ব্যথার কারণ ও হয়তে পারে। জোয়াখিম লো লাটভিয়া এর সাথে শেষ প্রস্তুতিমূলক ম্যাচ খেলানোর মাধ্যমে অন্তত তিন বছর পর
একটু সুস্থির হয়েছিলেন একাদশ এর ব্যাপারে। মিডিয়ার চাপ, ট্যাকটিকস এর ব্যাপারে রক্ষণশীলতা ও ব্যক্তিগত পছন্দের কারনে ইংল্যান্ড কোচ সাউথগেট একাদশ সাজাতে গিয়ে দল এর সহজাত গতি কমিয়ে দিচ্ছেন, তবেঁ এক্ষণ পর্যন্ত তাঁর বাজি কাজে দিয়েছে। মোরাতার ফর্মহীনতা, মিডফিল্ড এ সৃজনশীলতার অভাব এ লুইস এনরিকে এখনো তার সেরা একাদশ খুঁজে পেতে হিমশিম খেলেও, শেষ তিন ম্যাচে দল গুছিয়ে এনেছেন। ফার্নান্দো সান্তোস রেনাটো সাঞ্চেস কে দুই ম্যাচ বেঞ্চ থেকে শুরু করানোর ভুল এর পিছনেও অনেক বিকল্প থাকাকেই প্রধান ধরা হচ্ছে। ইটালি এর কোচ মানচিনি এর এমন কোন সমস্যা নেই, জুভেন্টাস এর চিয়েসা কে গ্রুপ পর্বে বসিয়ে রাখতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা বোধ করেন না তিনি, আরো ইনফর্ম বেরার্দি এর জন্যে- যেই কারনে ইটালি এর খেলায় একটা ছন্দ দেখা যাচ্ছে। বেলজিয়াম কোচ মার্টিনেজ ও ফ্রান্স কোচ ডেশম ডিফেন্স এর ব্যপারে মন স্থির করতে করতে না পারার মাশুল দিয়েছেন শিরোপা দৌড় থেকে ছিটকে পড়ে। বেলজিয়াম এর বর্ষিয়ান রক্ষণ ভাগ ইটালি এর গতি এর সাথে কুলিয়ে উঠতে পারে নি, ফ্রান্স এর শেষ ম্যাচ এর তিন জন এর রক্ষণভাগ মার্কিং এ ভুল করে সুইজারল্যান্ড কে ম্যাচ এ ফিরিয়ে এনেছিল।
৪- একটা ফাংশনিং মিডফিল্ড এর সূত্রঃ
মিডফিল্ড এ দখল নিতে আসলে কি চাই? পর্তুগাল এর কোচ সান্টস এর জায়গায় আপনি থাকলে কি দল এর এটাকার দের নিশ্চয়তা দেয়ার জন্য দুইজন ডিফেন্সিভ মিড খেলাতেন, নাকি রেনাট সাঞ্চেজ এর মত গতি ও শক্তিতে ভরপুর খেলোয়াড় কে নামাবেন? ক্রুস- গুন্দোগান, দুইজন এ টেকনিক এর দিক দিয়ে অসাধারণ ফুটবলার। কিন্তু ত্রিশ্বোর্ধ ক্রুস আর মধ্যম উচ্চতার গুন্ডোগান কে কান্তে ও পগবা এর বিপরীত এ হিমশিম খেতে দেখে আপনার কি মনে হয় নি যে গোরেতজকা কে সেখানে পেলে ফ্রান্স কে আরো টক্কর দেয়া যেত? ইটালি জর্জিনহো এর গতির অভাব কে বারেলা আর লোকাতেল্লি এর রানিং ও পজিশনিং দিয়ে ঢেকে দিচ্ছে, আর জর্জিনহো ও সুযোগ পেয়ে মাঠে ছড়ি ঘুরাচ্ছেন। হল্যান্ড ডিজং এর বল ক্যারিং, ভাইনাল্ডুম এর লেট রান, ডি রুন এর ট্যাকলিং কে পুঁজি করে মাঝমাঠের দখল নিয়েছিল। ডেনমার্ক এরিকসেন কে হারানোর পরে মিডফিল্ড এ শক্তি না বাড়িয়ে ডিলানি ও হয়ব্যার্গ কে ডাবল পিভট ডি এম এ না খলিয়ে সেন্ট্রাল বক্স টু বক্স এ খেলিয়ে সাফল্য পাওয়া শুরু করেছে। সব কিছু দেখে আপাত সিদ্ধান্তে আসা যায় যে (ক) দল এ একজন কমপক্ষে সারাক্ষণ দৌড়াতে পারে/ দীর্ঘ/ শক্তিশালী এমন এক মিড দরকার (খ) এক জন মিড দরকার যিনি বিপক্ষ রক্ষণ কে ওয়ান টু ওয়ান/ থ্রু/ লেট রান এর মাধ্যমে ভেঙ্গে ফেলতে পারেন (গ) দুইজন ডিফেন্সিভ মিড খেলালে আক্রমণের ধার কমে যায় (ইংল্যান্ড) (ঘ) দুইজন ধীরগতির মিডফিল্ডার না খেলানো উত্তম ( জার্মানি)
৫- গ্রুপ ও নক আউট স্টেজ এ ট্যাকটিক্স এর ভিন্নতাঃ
এই ইউরো থেকে কিছু ট্যাকটিকাল কাজ যা কোচেরা অনেক দিন ধরেই প্রয়োগ করে আসছেন তা গ্রুপ পর্বে আবেদন হারিয়ে ফেলেছিল। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, পর্তুগাল ডাবল পিভট/ ডিফেন্সিভ মিড খেলিয়ে মধ্যমাঠে ধার এর জায়গায় স্থবিরতা বাড়িয়ে দেওয়া এবং ইটালি, স্পেন তিন জন এর মিডফিল্ড (হোল্ডিং, রানার, ক্রিয়েটর) খেলিয়ে গ্রুপ স্টেজ এবুং নকআউট এ মিডফিল্ড ও আক্রমণ এর যোগসূত্রতা বাড়িয়ে দেওয়া- দুই জন ডিফেন্সিভ মিড এর অনেক দিন এর পরীক্ষিত সূত্রকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছিল। এছাড়াও, ফুলব্যাক রা ক্লাব ফুটবল এ এরিয়াল ক্রস এর মাধ্যমে দীর্ঘ গড়নের ফরোয়ার্ড দের কাজে লাগিয়ে গোল আদায় করানো টা গ্রুপ স্টেজ এ কমে গিয়েছিল, কিন্তু ইংল্যান্ড ও সুইজারল্যান্ড এর মাধ্যমে আবার তা ফিরে এসেছে নক আউট স্টেজ এ। ফুলব্যাক রা আন্ডার ল্যাপ করে এটাকার বা মিডফিল্ডার দের সাথে কম্বিনেশন প্লে করা অথবা নিজেই গ্রাউন্ড বল দেওয়ার পাশাপাশি এক্ষণ বাতাসেও বল দিচ্ছেন স্ট্রাইকার দের । চার জন এর ডিফেন্স এর টেমপ্লেট ও হুমকির মুখে পড়ে গিয়েছিল ৩-৪-৩ এর দাপটে গ্রুপ স্টেজ এ, কিন্তু শেষ দিকে এসে ইটালি, স্পেন (ও ক্ষেত্রে বিশেষে ইংল্যান্ড) ৪ ডিফেন্ডার এর জয়জয়কার আবার ফিরিয়ে এনেছেন। বিশেষ করে বেলজিয়াম এর তিন জন এর রক্ষণভাগ এর কাড়নে মাঝমাঠে দখল হারানোয় ইটালি এর ছড়ি ঘুরানো টা ৪-৩-৩ এর সামনে ৩-৪-৩ বা ৩-৫-২ এর কার্যকারীতা কে বিশেষ হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে।
এমন আরো অনেক কিছুই আমরা আশা করব সামনের তিন ম্যাচ থেকে। স্পিনাজ্জোলা কে হারানো ইটালি কিভাবে নতুন ট্যাকটিক্স সাজাবে? স্পেন কি আবারো অতিরিক্ত সময়ে যাওয়ার ঝুঁকি নিবে না ৯০ মিনিটেই খেলা শেষ করে দেওয়ার ট্যাকটিক্স নিয়ে নামবে? ইংল্যান্ড কি ৩-৪-৩ না ৪-২-৩-১, কোন ফর্মেশন এ ডেনমার্ক এর কম্বিনেশন প্লে কে আটকাবে? আর কি চমক নিইয়ে অপেক্ষা করছে জোয়াকিম মায়হেল, ডল্বার্গ এ উজ্জীবিত ডেনমার্ক?
অপেক্ষার প্রহর ফুরালো বলে!

Leave a Reply

FPL promoted picks: Norwich. Will they maintain their old record!!

FPL PROMOTED PICKS: Can BRENTFORD become “The New Leeds” ?